স্বামী প্রণবানন্দজি অবিভক্ত ভারতবর্ষের পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমার অন্তর্গত বাজিতপুর গ্রামে ১৩০২ বঙ্গাব্দের ১৬ মাঘ (১৮৯৬ সালের ২৯ জানুয়ারি) পূর্ণিমা তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বিষ্ণুচরণ দাস (ভুঁইয়া) ও মাতা সারদা দেবী। পরিবারের কুলদেবতা ছিলেন নীলরুদ্র শিব। মধ্যযুগে বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে এই পরিবারের আত্মীয়তা ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। সেজন্য তাঁদের পদবির সঙ্গে সম্মানসূচক ‘ভুঁইয়া’ যুক্ত হয়। ভুঁইয়া অর্থে ভূমধ্যকারী বা জমিদার বোঝায়। বিষ্ণুচরণ তাঁর তৃতীয় পুত্রকে আদর করে ডাকতেন জয়নাথ। বুধবারে জন্ম বলে বাড়ির কেউ কেউ তাঁকে বুধো বলে ডাকত। অন্নপ্রাশনের সময় তাঁর নাম রাখা হয় বিনোদ।
শৈশবকাল থেকেই অত্যন্ত শান্ত, ধীর-স্থির ছিল বিনোদ। পড়ত বাজিতপুর স্কুলে। প্রায়শই নিজের চিন্তায় ডুবে থাকত। প্রত্যহ কয়েক ঘণ্টা ধ্যান করত। এইভাবে বালক বিনোদ ধীরে ধীরে ব্রহ্মচারী বিনোদে পরিণত হল। আহারে বিশেষ রুচি ছিল না। নুন ভাত, জল ভাত, আলু সেদ্ধ ভাত, ভাত ছিল তাঁর খাদ্য। অথচ এই খেয়েই প্রত্যহ মুগুর ভাঁজতেন, অজস্রবার ডন বৈঠক দিতেন। শরীরে ছিল হস্তীর বল। ১৯১৭-এ মাঘী পূর্ণিমার দিনই বাজিতপুরে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯২৩-এ মাঘী পূর্ণিমার দিন সঙ্ঘের নামকরণ করা হয়- ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’।
বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্ক: পূর্ববঙ্গের বিপ্লবীদের সঙ্গে ব্রহ্মচারী বিনোদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বিশেষত ফরিদপুর জেলার বিখ্যাত বিপ্লবী সন্তোষ দত্ত ও পূর্ণচন্দ্র দাসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল। নিশিকান্ত দত্ত আচার্যের ঘনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন। তিনি লিখছেন— একদিন রাত্রি প্রায় ২টা বাজে। ধরণী গভীর সুপ্তিমগ্না, প্রকৃতি নীরব, নিথর। আশ্রমের কুটিরে আমি ও ব্রহ্মচারীজি শায়িত আছি। হঠাৎ কে যেন দরজায় মৃদু করাঘাত করে অনুচ্চ স্বরে ডাকল—‘‘বিনোদ দা আছেন নাকি?’’ এত গভীর রাতে সেই ডাক শুনে ব্রহ্মচারীজি উঠে বসে বললেন—‘‘দরজা খুলুন।’’ আমি দরজা খুলে দেখি ৩-৪ জন যুবক সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। আলো জ্বালতে গেলে তিনি নিষেধ করলেন। আগন্তুক যুবকদের তিনি ভিতরে ডাকলেন। তারা একজন তাঁর কানে কানে কী বলল ও তারপর বাইরে জঙ্গলের ভিতরে চলে গেল। তিনি আমাকে বললেন—‘‘শীঘ্র সাতজনের মতো ভাত-ডাল রান্না করতে হবে। এরা আজ সারাদিন কিছু খায়নি।’’ আসলে ব্রিটিশ পুলিসের তাড়া খেয়ে এই যুবকদল সারাদিন ধরে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। ফলে, সারাদিন কিছু খেতেও পারেনি। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এই বিপ্লবী দলকে তিনি খাওয়ান। তারপর তাঁরা বিদায় নেয়। এরকম ঘটনা আরও দু-তিনবার ঘটেছিল।
জনসেবায় হাতেখড়ি: ১৯২১-এ খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমায় ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সংবাদ পেয়েই প্রণবানন্দজি তাঁর অনুগত ছাত্র ও তরুণদের নিয়ে সেই অঞ্চলে ছুটে গিয়ে সেবাকার্য আরম্ভ করেন। কিন্তু এই বিরাট সেবাকার্যে বহুলোক ও বহু অর্থের প্রয়োজন। খুলনা জেলার অন্যতম সুসন্তান ভারত বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয় ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অর্থ সংগ্রহ করে আচার্য দেবের পিছনে দাঁড়ালেন। প্রণবানন্দও বিভিন্ন স্কুলে-কলেজে ঘুরে ঘুরে প্রায় ৫০০ জন তরুণ কর্মী সংগ্রহ করলেন। তাদেরকে দিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রায় আটমাস যাবৎ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সেবাকার্য পরিচালনা করলেন। এই ঘটনার পর প্রণবানন্দজির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
শক্তি সাধনার প্রবর্তন: আচার্য দেবের ইচ্ছা ছিল যে তিনি জাতীয় জীবনে শক্তিসাধনার প্রবর্তন করবেন। ১৯২৮-এ তীর্থশ্রেষ্ঠ কাশীধামে তিনি দুর্গাপূজা শুরু করেন। শক্তিপূজা প্রসঙ্গে প্রণবানন্দ বলেন, ‘‘হিন্দু তুমি কি জান না যে তুমি শক্তির পূজক, মহাশক্তির উপাসক? তোমার সেই শক্তির সাধনা কোথায়? একবার ধীর, স্থির হয়ে চিন্তা কর—তোমার উপাস্য দেবদেবীর সেই মহাবীরত্ব-ব্যঞ্জক লীলাভিনয়। শিবের হাতে ত্রিশূল, তাহা দেখে তুমি কি চিন্তা করবে? শ্রীকৃষ্ণের হাতে সুদর্শন, শ্রীরামচন্দ্রের হাতে ধনুর্বাণ, মা কালীর হাতে রক্তাক্ত খড়্গ—তাহা দেখে তুমি কী ভাবনা ভাববে? দশ হস্তে দশপ্রহরণধারিণী মা দুর্গার দিকে তাকিয়ে তোমার ভিতরে কী চিন্তা আসবে? এই মহাশক্তির সাধনা করে কি মানুষ দুর্বল হয়, না সবল হয়? সাধক, একবার বিশেষভাবে এই সমস্ত কথা চিন্তা কর। তারপর তুমি ভেবে ও বুঝে দেখ যে, তোমার শক্তির পূজা ও সাধনা ঠিক ঠিক হচ্ছে কি না। যদি না-হয়ে থাকে, তবে ঠিক কর যে— এখন থেকে কীভাবে তোমার আরাধ্য দেবতার পূজা উপাসনা করবে?’’
হিন্দু মিলনমন্দির ও হিন্দুরক্ষীদল গঠন: হিন্দু সমাজ সমন্বয় আন্দোলন তথা হিন্দু মিলন মন্দির ও রক্ষীদল গঠন আন্দোলন প্রবর্তন মহারাজ প্রণবানন্দজির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান। ১৯৩৪ সালের শেষ থেকে তিনি এই আন্দোলন আরম্ভ করেন এবং তখন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন—‘‘সর্বশেষে সর্বনিয়ন্তার বিশেষ ইচ্ছায় হিন্দু সংগঠন ও হিন্দু মিলন মন্দির আন্দোলনের আরম্ভ- অধ্যাত্ম সাধনার মহাব্রত। ভারতের তথা সমগ্র বিশ্বের মঙ্গল ইহাতেই নিহিত রয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন—‘‘হিন্দুতে হিন্দুতে মিলন শীঘ্র গড়ে উঠবে, হিন্দু-মুসলমান—খ্রিস্টানে মিলন তত তীব্র সম্ভব হয়। কারণ মিলন হয়—সমানে-সমানে, সবলে-সবলে; সবলে ও দুর্বলে কখনো মিলন হয় না। সুতরাং বিশাল হিন্দু জনগণ যখন সমস্ত ভেদ-বিবাদ-বিরোধ ও অস্পৃশ্যতা ভুলে সম্মিলিত ও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হবে, তখনই অন্যান্য জাতির সঙ্গে তার মিলন সহজ ও সম্ভব হবে।’’ হিন্দুদের গলদ সম্পর্কে তিনি বলছেন—‘‘হিন্দুর বিদ্যা আছে, বুদ্ধি আছে, অর্থ আছে, ব্যক্তিগত শক্তি-সামর্থ্যও যথেষ্ট আছে। কিন্তু নাই কেবল তাদের মধ্যে একতা, সঙ্ঘবদ্ধতা বা সংহতি শক্তি। তাদের মধ্যে এই সঙ্ঘশক্তি জাগিয়ে দিতে পারলেই হিন্দুজাতি জগতে অজেয় হয়ে দাঁড়াবে।’’ এই দোষ-ত্রুটি-দুর্বলতা দূর করার জন্যই তিনি ‘হিন্দুমিলন মন্দির’ আন্দোলন আরম্ভ করেন।
তা ছাড়া গ্রামের সমস্ত যুবকদের নিয়ে প্রত্যেক মিলনমন্দিরে একটি করে ‘হিন্দুরক্ষীদল’ গঠন করা হবে। এই রক্ষীদল সম্পর্কে আচার্য প্রণবানন্দ বলেন—‘‘সমগ্র হিন্দু-সমাজকে ধর্ম-মান-ইজ্জত, স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার্থে সজাগ ও সতর্ক করে তুলবার জন্যই আমার এই রক্ষীদল গঠন আন্দোলন। অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জন্য স্থিরসঙ্কল্প যে, দেহে একবিন্দু রক্ত থাকতেও হিন্দুর ধর্ম, মান, ইজ্জত, স্বার্থ ও অধিকারে কাকেও হস্তক্ষেপ করতে দিব না—এরূপ সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা যার সেই হবে প্রকৃত রক্ষী।’’
শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রণবানন্দজির সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে ভারত সেবাশ্রমের সন্ন্যাসী স্বামী অরুণানন্দ তাঁর ‘শ্রীশ্রীপ্রণবানন্দচরিতামৃত’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১০০) লিখেছেন, ‘‘১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দের অগাস্ট মাসে জন্মাষ্টমীর শুভ তিথিতে কলিকাতার বালিগঞ্জে এক বিরাট হিন্দুধর্ম সম্মেলনে প্রখ্যাত দেশনেতা বাঙ্গালীর গৌরব ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে সভাপতি নির্বাচন করা হয়। সম্মেলনের পূর্বে ভগবান আচার্যদেব পর পর পাঁচদিন শ্যামাপ্রসাদ মহাশয়কে তাঁর নিকটে আনবার জন্য সন্ন্যাসীদের প্রেরণ করেন। কিন্তু অত্যধিক কাজের চাপে তিনি তখন আসতে পারেন নাই। শেষে জন্মাষ্টমীর সম্মেলনের দিন বৈকাল ৫টায় শ্রীমৎ আচার্যদেব মণ্ডপের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রীযুত শ্যামাপ্রসাদ মহাশয় এসে পৌঁছিলে শ্রীমৎ আচার্যদেব তাঁকে নিয়ে সভামণ্ডপে উঠলেন। মঞ্চের উপর উঠে শ্রীশ্রী আচার্যদেব সহস্র সহস্র উৎসুক দর্শকের সামনে স্বীয় কণ্ঠের আশীর্বাদী ফুলমালা স্বহস্তে শ্রীযুত শ্যামাপ্রসাদ মহাশয়ের গলায় পরিয়ে দিয়ে আশীর্বাদদান ও শক্তিসঞ্চারপূর্বক স্বীয় আসন গ্রহণ করেন। এতে প্রবীণ সঙ্ঘ-সন্ন্যাসীগণ এবং দর্শক জনসাধারণ বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে যান। কারণ ইতিপূর্বে শ্রীশ্রী আচার্যদেব কখনও কাহারও গলায় স্বহস্তে মালা পরিয়ে দেন নাই। সম্মেলনের শেষে বিশ্রাম মন্দিরের কক্ষে প্রবেশ করে তিনি পূজ্য শ্রীমৎ স্বামী বেদানন্দজিকে শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—‘‘আজ বাঙ্গালী হিন্দুর স্বপক্ষে দাঁড়াবার লোক ঠিক করে দিয়ে এলাম’’।
এর কিছু মাস পরেই ১৯৪১ সালের ৮ জানুয়ারি আচার্য প্রণবানন্দজি কলকাতার বালিগঞ্জ আশ্রমে দেহত্যাগ করেন।